ওয়েবসাইট তৈরির আগে যে ৭ টি বিষয়

ওয়েবসাইট তৈরির আগে যে ৭ টি বিষয় জানা উচিত

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। এই যুগে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার ছাড়া চলা মুসকিল। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে অনেক দূর। কেউ কেউ এই প্রযুক্তি ব্যবসা ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে ইনকাম করছে বহু টাকা। অধিকাংশ মানুষের হাতে স্মার্টফোন থাকায় ব্যবসায়ীদের চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। তারা তাদের ব্যবসায়কে কিভাবে এবং কোন উপায়ে বেশি মানুষের কাছে পৌছাতে পারে সেই বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করছে বড় বড় আইটি কোম্পানিগুলো।  

অনেক আগেই তারা আবিষ্কার করেছে যে ওয়েবসাইট হল আধুনিক বা ডিজিটাল দোকান যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে ব্যবসার পণ্য বা সেবা পৌছানো সম্ভব। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বর্তমানে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যবসায় প্রসার ঘটানোর জন্য চিন্তা করছে। এজন্য দেশে গড়ে উঠেছে অনেক এজেন্সি। যারা একটি স্বপ্নের ওয়েবসাইটি বানিয়ে ব্যবসার পণ্য বা সেবা পৌছে দিবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে।   

কেউ কেউ এই ওয়েবসাইট বানাতে গিয়ে হচ্ছে প্রতারিত আবার কেউ কেউ ঠকে যাচ্ছে । যে বিষয়গুলোর অজ্ঞতার জন্য যারা ঠকে যাচ্ছে বা প্রতারিত হচ্ছে সেই বিষয়গুলো নিয়েই আজকের আলোচনা। ওয়েবসাইট তৈরির আগে একজন গ্রাহকের কি কি বিষয় জানা উচিত তা আজকের এই লেখায় বর্ণণা করা হল-

১. ডোমেইন ও হোস্টিং

একটি ওয়েবসাইট তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ উপাদান হল ডোমেইন ও হোস্টিং। ডোমেইন হল ওয়েবসাইটের নাম আর হোস্টিং হল সার্ভার বা অনলাইন মেমরী, যেখানে ওয়েবসাইটের সকল তথ্য, ছবি ও ভিডিও সংরক্ষিত থাকবে।

ব্যবসায়ের নাম অনুযায়ী ডোমেইন নাম ঠিক করা উচিত এবং ব্যবসায়ের আকার অনুযায়ী হোস্টিং প্রয়োজন। সম্ভব হলে ডোমেইন হোস্টিং একই কোম্পানি থেকে কিনুন তাহলে তাদের সাপোর্ট পেতে সুবিধা হবে। 

ছোট ব্যবসার জন্য ৫/১০ জিবি হোস্টিং আর বড় ব্যবসার জন্য ২০ জিবি হোস্টিং দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০ জিবি হোস্টিং ১৪০০ টাকা নিবে এবং ২০ জিবি হোস্টিং ১৮০০ টাকা খরচ পড়বে। অন্যদিকে ডটকম(.com) ডোমেইন, কোম্পানি বা এজেন্সিভেদে ৯০০-১০০০ টাকা নিবে । 

আপনি নিজেও ডোমেইন হোস্টং কিনতে পারেন কিংবা যে এজেন্সি থেকে ওয়েবসাইট বানাবেন সে এজেন্সি থেকেও মাধ্যমে কিনতে পারেন। 

তবে সতর্কতার বিষয় হল যে এজেন্সি আপানার ব্যবসার ডোমেইন হোস্টিং যে কোম্পানি থেকে কিনবে সে কোম্পানির এড্রেসটা নিয়ে নিবেন, যাতে ডোমেইন-হোস্টিং রিনিউ করার সময় আপনি সরাসরি কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে নিজে নিজে রিনিউ করতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, আপনি যে এজেন্সি থেকে ওয়েবসাইট বানিয়েছেন সেটি একসময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। 

এক্ষেত্রে আপনি যদি ডোমেইন-হোস্টিং কোম্পানির ঠিকানা না জানেন তাহলে বন্ধ এজেন্সি রিনিউর জন্য আপনার কাছ থেকে অনেক বেশি টাকা চাইবে। ফলে আপনি প্রতারিত হতে পারেন। তাই অবশ্যই ওয়েবসাইট বানানোর সময় ডোমেইন-হোস্টিং কোম্পানির এড্রেস জেনে নিবেন। 

২. ওয়েবসাইট প্লাটফর্ম

বর্তমানে বাংলাদেশে ৩টি প্লাটফর্ম বা ৩টি মাধ্যমে ওয়েবসাইট বানানো হচ্ছে। ওয়ার্ডপ্রেস , লারাভেল ও রিয়েক্ট। এই প্লাটফর্মগুলোর মধ্যে ওয়ার্ডপ্রেস ও লারাভেল ওয়েবসাইট হল বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। 

ওয়ার্ডপ্রেস হল পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সিএমএস সফটওয়্যার। এটি দিয়ে খুব সহজে ওয়েবসাইট বানানো যায় এবং এটি পরিচালনা করাও সহজ। থিম-প্লাগিন ব্যবহার করে এই ওয়েবসাইট বানানো যায়। ওয়েবসাইট বানাতে কোডিং করার কাজ তেমন নেই বললেই চলে।

বর্তমানে ওয়ার্ডপ্রেসের ফ্রী থিম দিয়ে একটি ইকমার্স ওয়েবসাইট বানাতে ও ডিজাইন করতে এজেন্সিভেদে ১০,০০০-২০,০০০ টাকা নিয়ে থাকে যা পেইড থিম দিয়ে তৈরী করতে খরচ পরবে ৩০০০০-৪০০০০ টাকা।

অন্যদিকে লারাভেল ওয়েবসাইট হল পিএইচপি প্রোগ্রামিং ভাষার একটি ফ্রেম ভাষা। এই ধরনের ওয়েবসাইট সম্পুর্ন কোডিং করে করতে হয়। বর্তমানে যদিও এ ভাষার অনেক টেম্পপ্লেট রয়েছে তারপরও ওয়েবসাইট কাস্টমাইজ করতে কোডিং প্রয়োজন। এজন্য এই ওয়েবসাইটের খরচ তুলনামুলকভাবে বেশি । 

বর্তমানে লারাভেল দিয়ে কোডিং করে একটি ইকমার্স ওয়েবসাইট বানাতে ও ডিজাইন করতে এজেন্সিভেদে ৪০০০০-৫০০০০+ টাকার মত খরচ পড়বে। 

সাবধানের বিষয় হল– ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে অনেক এজেন্সি অল্প টাকায় ওয়েবসাইট ডিজাইন করতে গিয়ে পেইড-ক্র্যাক থিম ও প্লাগিন ব্যবহার করে ওয়েবসাইটের প্রিমিয়াম লুক দেয়। এতে গ্রাহকরা সন্তুষ্টি হয় ঠিকই কিন্তু কয়েকদিন পর দেখা যায় থিম-প্লাগিন আর আপডেট করা যায় না। এতে ওয়েবসাইট স্লো হয়ে যায় এবং ওয়েবসাইটে ভাইরাসের আক্রমন ঘটে থাকে। তাই কম প্রাইসে ওয়েবসাইট বানালে ফ্রি থিম-প্লাগিন ব্যবহার করা উচিত।  

৩. স্পিড ইস্যু

ওয়েবসাইট যত বেশি চাক্যচিক্য করবেন তত বেশি স্পীড কম হবে। আর স্পীড যত কম হবে আপনার ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারীরা তত বেশি বিরক্ত হবে। ফলে আপনার কাস্টমাররা অন্য ওয়েবসাইটে চলে যাবে।

যে এজেন্সি থেকে ওয়েবসাইট বানাবেন তাদের বলবেন যেন প্রতিটি ছবি ও ভিডিও কম্প্রেসড করে নেয় যাতে হোস্টিং এ কম চাপ পড়ে।

আর প্রয়োজনীয় ফাংশনাল ডিজাইন ছাড়া অতিরিক্ত ভারি ডিজাইন না করাই ভাল। মনে রাখবেন, আপানার ব্যবসায়ের ওয়েবসাইটের ডিজাইন দেখতে কাস্টমারা আসবে না তারা আসবে প্রোডাক্ট কিনতে। তারা দেখবে ফাংশনালাটি যেন খুব সহজে তারা অর্ডার করতে পারবে। সেজন্য আপনাকে স্পীড অপটিমাইজেশনের দিকে নজর দিতে হবে।  

৪. রেস্পন্সসিভ কিনা

ওয়েবসাইট রেস্পন্সসিভ মানে হল আপনার ওয়েবসাইটটি ৩টি ডিভাইসে যথা- মোবাইল, ট্যাব ও কম্পিউটারে চলে কিনা সেটা নিশ্চিত করা। ওয়েবসাইট বানানোর সময় আপনি এজেন্সিকে রেস্পন্সসিভের ব্যপারে জানাবেন এবং ওয়েবসাইট হাতে পাওয়ার পর সেটি ভাল করে চেক করে নিবেন। 

৫. এজেন্সির পেশাদ্বারিত্ব

অনেকে ওয়েবসাইট বানাতে গিয়ে ফেইক ওয়েবসাইট ডিজাইন কোম্পানি দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। ফেজবুক পেজে লাইক আর কমেন্ট দেখে অনেকেই আকর্ষিত হয়েও ওয়েবসাইট বানাতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছে। ফেসবুকে ফেইক লাইক ও ফেইক কমেন্ট চাইলেই কিনে নেয়া যায়। তাই শুধু ফেসবুক পেজ লাইক দেখে একটা এজেন্সি যাচাই করা বোকামি।   

বাংলাদেশে অনেক এজেন্সি আছে। আবার অনেক এজেন্সি চালু হচ্ছে এবং বন্ধ হচ্ছে। আপনার ব্যবসায় বা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বানাতে আপনাকে একটি ভাল ও পেশাদার ওয়েবসাইট ডিজাইন কোম্পানির খোঁজ নিতে হবে। ভাল এজেন্সি ও পেশাদ্বার এজেন্সি চেনার ৩ টি কার্যকরি উপায় হল- 

  • ফেসবুক পেজের এক্টিভিটি দেখে নিবেন এবং পেজের About গিয়ে page transparecy অপশনে গিয়ে দেখে নিবেন পেজটি কবে তৈরি করা হয়েছে। পুরানো পেজ মানে ১-৩ বছরের পেজ হলে এবং পেজের এক্টিভিটি ভাল থাকলে সে পেজ থেকে ওয়েবসাইট বানানোর জন্য চিন্তা করতে পারেন। 
  • ফেসবুক পেজের লাইক সংখ্যা যেন মিনিমাম ১০০০ হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। নতুন পেজ বা আরও কম লাইকের পেজ হলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 
  • এজেন্সির নিজেদের অবশ্যই সার্ভিস ওয়েবসাইট থাকতে হবে। ওয়েবসাইট ভালভাবে ভিজিট করুন। তাদের ওয়েবসাইট গোছালো কিনা দেখুন। তাদের সঠিক এড্রেস বা ঠিকানা দেয়া আছে কিনা ভাল করে দেখে নিন। 
  • আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ওয়েবসাইটে তাদের নিজেদের লিখা ব্লগ বা আর্টিকেল আছে কিনা দেখে নিন। নরমালি পেশাদ্বার এজেন্সি বা সিরিয়াস এজেন্সিরা অবশ্যই তাদের ওয়েবসাইটে লিখালিখা করে থাকে। তাই ভাল এজেন্সি খোঁজার ক্ষেত্রে এই বিষটি মাথা রাখবেন।   
  • সরাসরি কল দিয়ে তাদের সাথে বিস্তারিত কথা বলুন। আপনার প্রশ্নের জবাব তারা ঠিকঠাক দিতে পারছে কিনা সেটা যাচাই করুন। তারা ফ্রেন্ডলি ও সাপোর্টিভ কিনা লক্ষ্য করুন। 

৬. চারটি বেসিক পেজ

মূলত একটি বিজনেস ওয়েবসাইটের ৪টি ব্যসিক পেজ থাকা বাধ্যতামুলক। পেজ গুলো হল – Home Page , Product/Service Page , About Page ,Contact Page।

ওয়েবসাইট বানানো পূর্বে এই চারটি পেজ ঠিকঠাক কিনা যাচাই করুন।  

৭. ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড

ওয়েবসাইট বানানো শেষ হলে এজেন্সি থেকে প্রয়োজনীয় ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে নিবেন। সাধারনত ২টি ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে নিবেন। সেগুলো হল-

  • ওয়েবসাইটের ড্যসবোর্ড এর ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড
  • সি প্যানেলের লগিন ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড

সবশেষে

ওয়েবসাইট আপানার ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় বহন করে। আপনার ব্যবসায়ের অনলাইন ভার্শন হল ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটের এই ব্যসিক বিষয়গুলো না জানার কারনে কিছু অনলাইন ফেইক এজেন্সি গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে যাছে। 

কেউ অধিক টাকা নিচ্ছে আবার কেউ কেউ এত অল্প টাকা নিচ্ছে যে ওয়েবসাইটের গুনগত মান নস্ট করে ওয়েবসাইট বানিয়ে দিচ্ছে। 

যারা অনলাইনে স্থায়ীভাবে ব্যবসায় করতে চান তাদের জন্য ওয়েবসাইট করাটা একটা স্বপ্নের মত ব্যাপার। দারাজ-আমাজনের মত লক্ষ লক্ষ  মানুষ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করবে এবং প্রচুর অর্ডার আসবে- এরকম ভাবনা স্বপ্নের মত। 

তাই ওয়েবসাইট বানানোর সময় এই ৭টি বিষয় ভালভাবে গুরুত্ব দিয়ে আপানার স্বপ্নের ওয়েবসাইট তৈরির কাজে হত দিন । আপনার জন্য রইল শুভ কামনা।